পান্তা ভাত খেলে কি হয় | সকালে পান্তা ভাতের উপকারিতা

সকালে পান্তা ভাতের উপকারিতা  নিয়ে আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেতে চান? ঐতিহ্যবাহী এই খাবারটি কিভাবে আপনার স্বাস্থ্যের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে, তা জানতে পারবেন আজকের এই লেখায়। পান্তা ভাত খেলে কি হয়, এর পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি, হজমশক্তি বাড়ানো এবং শরীর ঠান্ডা রাখার অসাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।

সকালে-পান্তা-ভাতের-উপকারিতা

পান্তা ভাতের উপকারিতা ও অপকারিতা উভয় দিকই আমরা তুলে ধরেছি। অ্যালকোহল গঠনের ঝুঁকি, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার দূষণ এবং গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে, যা আপনাকে পান্তা ভাত সঠিকভাবে উপভোগ করতে সাহায্য করবে। 

পোস্ট সূচীপত্রঃ সকালে পান্তা ভাতের উপকারিতা

সকালে পান্তা ভাতের উপকারিতা

সকালে পান্তা ভাতের উপকারিতা নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, পান্তা ভাত বাঙালির এক দারুণ ঐতিহ্যবাহী খাবার। রাতে জলে ভিজিয়ে রাখা ভাত থেকে তৈরি হয় এই অমৃত, আর এই গাঁজন প্রক্রিয়াতেই ভাতের পুষ্টিগুণ বহুগুণ বেড়ে যায়, তৈরি হয় উপকারী ব্যাকটেরিয়া। সকালে পান্তা ভাত খাওয়া আমাদের শরীরের জন্য বিশেষভাবে উপকারী, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে।সকালে পান্তা ভাতের উপকারিতা সমূহ দেখে নিন।   

  • পুষ্টি বৃদ্ধিঃ পান্তা ভাতে আয়রনের পরিমাণ সাধারণ ভাতের চেয়ে ২১ গুণ বেশি পাওয়া যায়, ক্যালসিয়াম বৃদ্ধি পায় ৩৫১% এবং পটাশিয়ামও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ে। ভাবুন তো, আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে এই বৃদ্ধি কতটা জরুরি!
  • দ্রুত শক্তি প্রদানঃ কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ হওয়ায় সকালে পান্তা ভাত খেলে সারাদিনের কাজের জন্য আমরা তাৎক্ষণিক শক্তি পাই। সারাদিন সতেজ থাকতে এর জুড়ি মেলা ভার।
  • হজমশক্তি বৃদ্ধিঃ এর প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া আমাদের পেটের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে এবং হজমে দারুণ সহায়তা করে। একটা সুস্থ হজমতন্ত্র মানেই সুস্থ শরীর। 
  • শরীর ঠান্ডা রাখেঃ গরমের দিনে পান্তা ভাত আমাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং পানিশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে। 
  • রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণঃ সাধারণ ভাতের তুলনায় পান্তা ভাত রক্তে চিনির পরিমাণ কম বাড়ায়, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হতে পারে।

পান্তা ভাতের অপকারিতা

পান্তা ভাত, আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এক প্রিয় খাবার। এর উপকারিতা যেমন আছে, তেমনি কিছু দিক আছে যা নিয়ে আমাদের একটু সতর্ক থাকা জরুরি। বৈজ্ঞানিক গবেষণাও বলছে, এই গাঁজন প্রক্রিয়ার ধরন ও সময়ানুবর্তিতার ওপর এর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নির্ভর করে। যখন আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবি, তখন মনে হয়, ভালোবাসার খাবার বলে আমরা তো আর চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না, তাই না? চলুন, জেনে নিই পান্তা ভাতের অপকারিতা কী কী হতে পারে। 

পান্তা ভাতের কিছু সতর্কতা

  • অ্যালকোহল গঠনের ঝুঁকিঃ আমার মনে হয়, এই বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি ১২ ঘণ্টার বেশি সময় পান্তা ভাত ফার্মেন্টেশন করা হয়, তবে এতে ইথানল তৈরি হতে পারে। এর ফলে মাথা ঘোরা, ঝিমুনি বা কাজ করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। তাই সময়মতো পান্তা খাওয়াটা খুব জরুরি।
  • ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দূষণঃ এই বিষয়টি নিয়ে আমি সত্যিই চিন্তিত। যদি অপরিষ্কার পাত্রে বা দূষিত জল ব্যবহার করে পান্তা তৈরি করা হয়, তবে সালমোনেলা বা ই-কোলাই-এর মতো রোগজীবাণু বাড়তে পারে। এর থেকে ডায়রিয়া বা ফুড পয়জনিং হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তাই এখানে সবার আগে।
  • হিস্টামিন অসহিষ্ণুতাঃ গাঁজনের কারণে কিছু মানুষের মধ্যে হিস্টামিন নামক যৌগ অ্যালার্জি, মাথাব্যথা বা ত্বকে র্যাশ তৈরি করতে পারে। যদি এমন কোনো সমস্যা আপনাদের থেকে থাকে, তবে পান্তা খাওয়ার আগে একটু ভেবে দেখবেন।
  • ডায়াবেটিস ও স্থূলতা বৃদ্ধিঃ যদিও পান্তার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সাধারণ ভাতের চেয়ে কম, তবে অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে ক্যালোরি বেড়ে যেতে পারে এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সও তৈরি হতে পারে। তাই পরিমিতি বোধ রাখাটা সব খাবারেই জরুরি, পান্তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।
  • পেটের সমস্যাঃ প্রোবায়োটিক থাকলেও কিছু মানুষের পান্তা খেলে গ্যাস, বদহজম বা পেট ফাঁপা হতে দেখা যায়। এটা সব খাবারেই হতে পারে, কারণ সবার শরীর একরকম প্রতিক্রিয়া করে না।
  • লবণের প্রভাবঃ পান্তা ভাতে সোডিয়ামের মাত্রা বেশি থাকে, যা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই ব্যাপারটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

পান্তা ভাত খেলে কি গ্যাস কমে

পান্তা ভাত খেলে কি গ্যাস কমে? অনেকেই এই প্রশ্ন করেন। গবেষণা বলছে, পান্তা ভাতের গাঁজন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া হজমশক্তি বাড়িয়ে গ্যাস ও বদহজম কমাতে সাহায্য করে। দৈনিক জনকণ্ঠার মতে, এটি পাকস্থলীর পিএইচ (pH) নিয়ন্ত্রণ করে অম্লতা হ্রাস করে।

টাইমস নাউ ও ডাঃ ট্রাস্টের গবেষণায় ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা উঠে এসেছে, যা গ্যাস উৎপাদনকারী অণুজীব কমায়। তবে ১২ ঘণ্টার বেশি গাঁজন বা দূষিত পাত্রে তৈরি করলে সমস্যা বাড়তে পারে। সঠিক পান্তা গ্যাস কমালেও, এর প্রভাব ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। 

পান্তা ভাতে কি গ্যাস্ট্রিক হয়

পান্তা ভাতের সাথে গ্যাস্ট্রিকের সম্পর্কটা একটু জটিল, তাই না? পান্তা ভাতের গাঁজন প্রক্রিয়ায় যে ল্যাকটিক অ্যাসিড এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়, সেগুলো আমাদের হজমশক্তি বাড়িয়ে গ্যাস্ট্রিকের কষ্ট কমাতে সাহায্য করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, এটি পেটের ভেতরের প্রদাহ কমিয়ে গ্যাস্ট্রিক আলসার সারাতে ভূমিকা রাখে।

এমনকি, ইঁদুরের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, পান্তার নির্যাস পাকস্থলীর ক্ষতি ঠেকাতে পেরেছিল। তবে, এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার, যদি পান্তা ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ভিজিয়ে রাখা হয়, তাহলে এক ধরনের অ্যালকোহল তৈরি হতে পারে। এটি পেটের অ্যাসিডিটি বাড়িয়ে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।

বাংলাদেশের একটি সমীক্ষা ২০২৩ সালে দেখায়, ৩৫% মানুষ বেশি সময় ভিজিয়ে রাখা পান্তা খেয়ে অম্বল বা বুক জ্বালাপোড়ার কথা বলেছেন। এছাড়া, যদি পাত্র অপরিষ্কার থাকে, তাহলে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পেটে ঢুকে পেটের সমস্যা বাড়াতে পারে।

যদিও একটি ভারতীয় গবেষণা ২০২২ সালে বলেছে, পান্তার উপকারী ব্যাকটেরিয়া অ্যাসিডিটি কমায়, কিন্তু যাদের আগে থেকেই গ্যাস্ট্রিকের বড় সমস্যা আছে, পান্তার হালকা টক স্বাদ তাদের জন্য সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই, বুঝে শুনে খাওয়া উচিত।

পান্তা ভাত খেলে কেন ঘুম আসে

পান্তা ভাতের গাঁজন প্রক্রিয়ায় গামা-অ্যামিনোবিউটারিক অ্যাসিড (GABA) উৎপন্ন হয়, যা মস্তিষ্কের স্নায়ুক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে ঘুমের উদ্দীপনা বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ১০-১২ ঘণ্টা ফার্মেন্টেশনের সময় ভাতে ইথানল তৈরি হয়, যা স্নায়ুতন্ত্রকে শিথিল করে ঘুমের অনুভূতি আনে।

এছাড়া চালের প্রোটিন থেকে আসা ট্রিপটোফ্যান সেরোটোনিন ও মেলাটোনিন হরমোনে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের ঘুমের চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। ভারতীয় জার্নাল অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির মতে, পান্তা ভাতের ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া অন্ত্র-মস্তিষ্ক অক্ষকে সক্রিয় করে প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। তবে, ১২ ঘণ্টার বেশি ফার্মেন্টেশনে ইথানলের মাত্রা বেড়ে গেলে ঘুম ঘুম ভাব আরও তীব্র হতে পারে।

সকালে পান্তা ভাত খেলে কি মোটা হয়

গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে পান্তা ভাতের গাঁজন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া চর্বি বিপাককে ত্বরান্বিত করে ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ঢাকা মেইলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পান্তা ভাতে সাধারণ ভাতের চেয়ে ফ্যাটের পরিমাণ ৬ গুণ কম থাকে, যা স্থূলতা প্রতিরোধে কার্যকর। ভারতীয় জার্নাল অব নিউট্রিশনের গবেষণা নির্দেশ করে, পান্তার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭২ রক্তে গ্লুকোজের আকস্মিক বৃদ্ধি রোধ করে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

এশিয়ান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনের তথ্যমতে, ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে মাত্র ২০০-২৪২ ক্যালরি থাকে, যা ওজন বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। তবে, পান্তার সাথে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত ভাজা পদ বা ঘি যোগ করলে ক্যালরি গ্রহণ বাড়তে পারে। পুষ্টিবিদদের মতে, সঠিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত ও মৌলিক উপাদানে খাওয়া পান্তা ভাত ওজন কমাতে সাহায্য করে।

এক প্লেট পান্তা ভাতে কত ক্যালরি থাকে

পান্তা ভাতের ক্যালরি নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন আসে, তাই না? ১০০ গ্রাম সাধারণ পান্তা ভাতে প্রায় ৪৮-৫৪ ক্যালরি থাকে, কিন্তু চালের ধরন আর রান্নার ওপর নির্ভর করে এটা ২০০-২৪২ ক্যালরি পর্যন্ত হতে পারে। আমি তো অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি পান্তার সঙ্গে ১ চামচ ঘি মেশালে ১১২ ক্যালরি যোগ হয়।

ঢাকা মেইলের তথ্য অনুযায়ী, ২৫০ গ্রাম পান্তা ভাতে গড়ে ১২৫-১৬৬ ক্যালরি থাকে, যা সাধারণ ভাতের চেয়ে প্রায় ৩০-৪০% কম। এই ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় স্টার্চ ভেঙে যাওয়ার কারণে ক্যালরি সামান্য কমে আসে।

পান্তা ভাত কখন খাওয়া উচিত

পান্তা ভাত খাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো সকালবেলা, বিশেষ করে গরমের দিনে। আমি মনে করি, রাতে ৮-১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে এতে যে উপকারী প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়, তা আমাদের হজমশক্তি বাড়াতে আর শরীরকে ঠান্ডা রাখতে দারুণ সাহায্য করে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার গবেষণা বলছে, সকালে পান্তা ভাত খেলে সারাদিন শক্তি পাওয়া যায় এবং শরীর জলশূন্য হয় না। তবে একটা কথা, যারা ডায়াবেটিস রোগী, তাদের কিন্তু দুপুরে আগে ও অল্প পরিমাণে খাওয়া উচিত। আর খেয়াল রাখবেন, দূষিত পানি বা ১২ ঘণ্টার বেশি ভেজানো পান্তা কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। 

প্রতিদিন পান্তা ভাত খেলে কি হয়

পান্তা ভাতের নিয়মিত সেবন আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে, যা গবেষণা দ্বারাও প্রমাণিত। সঠিক উপায়ে তৈরি পান্তা ভাত উপকারী হলেও, ভুল পদ্ধতি বা অতিরিক্ত সেবনে কিন্তু কিছু ঝুঁকিও থাকে। আসুন, এর ভালো-মন্দ দিকগুলো একটু দেখে নিই।  

  • অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম উন্নত করেঃ পান্তার ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রের উপকারী জীবাণুর ভারসাম্য রক্ষা করে, যা আলসার বা আইবিএস-এর মতো ক্রনিক পেটের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
  • হরমোনাল ভারসাম্য রক্ষাঃ ফাইটোস্টেরল ও লিনোলেইক অ্যাসিড ইস্ট্রোজেন-টেস্টোস্টেরন অনুপাত নিয়ন্ত্রণ করে হরমোনজনিত জটিলতা কমায়।
  • ত্বকের সংক্রমণ রোধঃ এর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল যৌগগুলো একজিমা, ব্রণ ও ফাঙ্গাল ইনফেকশনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
  • রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ পান্তা ভাতে আয়রনের পরিমাণ ২১ গুণ বৃদ্ধি পায়, যা হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সাহায্য করে এবং অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে কার্যকর।
  • ইলেক্ট্রোলাইট ডিসব্যালেন্সের ঝুঁকিঃ প্রতিদিন অতিরিক্ত পান্তা খেলে পটাশিয়াম-সোডিয়াম অনুপাত বিঘ্নিত হয়ে হার্ট অ্যারিদমিয়া বা পেশি খিঁচুনি হতে পারে।
  • অ্যালকোহলিক লিভার ড্যামেজঃ ১২+ ঘণ্টার গাঁজনে ইথানল উৎপন্ন হয়, যা লিভারে ফ্যাটি অ্যাসিড জমা করতে পারে।
  • রক্তে গ্লুকোজ ওঠানামাঃ এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭২ হলেও, প্রতিদিন খেলে ইনসুলিন সেনসিটিভিটি কমে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
  • গবেষণা বলছে, সপ্তাহে ৩-৪ দিন সকালে ১০০-১৫০ গ্রাম পান্তা ভাত খাওয়াই সবচেয়ে ভালো।

পান্তা ভাত কতক্ষণ ভিজিয়ে রাখা উচিত

পান্তা ভাতের সঠিক গাঁজন আর পুষ্টিগুণ বাড়াতে ৮-১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা সবচেয়ে ভালো, এটাই গবেষণায় প্রমাণিত। এই সময়টায় ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া ভালোভাবে কাজ করে, আয়রনসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান বাড়ায়। তবে ১২ ঘণ্টার বেশি ভিজালে ইথানলের মাত্রা বেড়ে বিপজ্জনক হতে পারে।

মনে রাখবেন, ঢেঁকিছাঁটা লাল চালের জন্য ১০ ঘণ্টা আর মিনিকেট চালের জন্য ১২ ঘণ্টা ভিজানোই যথেষ্ট। ফুটানো ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করা খুব জরুরি, নয়তো ফিকাল কলিফর্ম দূষণের ঝুঁকি থাকে। আমি বিশ্বাস করি, সঠিক পদ্ধতি মেনে চললে পান্তা ভাত হবে পুষ্টিকর আর নিরাপদ।

পান্তা ভাত খাওয়ার নিয়ম

গবেষণা বলছে, পান্তা যদি ঠিকঠাক নিয়মে তৈরি ও খাওয়া যায়, তবে এটি স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। তবে, ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করলে কিন্তু খারাপও হতে পারে। আসুন, তাহলে জেনে নিই এই প্রিয় পান্তা ভাত কীভাবে তৈরি ও পরিবেশন করা উচিত। 

পান্তা ভাত প্রস্তুতির নিয়ম

  • সময়সীমাঃ ভাতকে ৮-১০ ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রাখুন, তবে ১২ ঘণ্টার বেশি একদমই রাখবেন না।
  • পরিষ্কার পাত্রঃ সংক্রমণ এড়াতে অবশ্যই পরিষ্কার পাত্র ব্যবহার করবেন।
  • বিশুদ্ধ জলঃ সব সময় পরিস্রুত বা বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করবেন।

পান্তা ভাত পরিবেশনার নিয়ম

  • সকালে সেবনঃ মূলত সকালের নাস্তা হিসেবে খাওয়া উত্তম।
  • সাথে মসলাঃ লবণ, লেবু, কাঁচা পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে খান।
  • পরিমিত পরিমাণঃ দৈনিক একবার পরিমিত পরিমাণে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।  

পান্তা ভাতের সাথে কি খাওয়া যায়

পান্তা ভাত আমাদের বাংলাদেশের এক চিরায়ত খাবার। গ্রামীণ জীবনে এর সাথে বিভিন্ন পদের ব্যবহার একে আরও সুস্বাদু ও পুষ্টিকর করে তোলে, যা পুষ্টিবিদরাও সমর্থন করেন। পান্তা ভাতের সাথে যা যা খাওয়া যায় তা হলোঃ 

  • ইলিশ মাছ ভাজাঃ আমাদের জাতীয় মাছ হিসেবে পান্তার সাথে এর তুলনা নেই।
  • শুঁটকি মাছঃ এটিও পান্তার সাথে একটি জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী পদ।
  • কাঁচা পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচঃ পান্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা স্বাদ বাড়ায়।
  • আলু ভর্তা ও আলু ভাজাঃ পান্তার সাথে আলুর যেকোনো পদই খুব সুস্বাদু লাগে।
  • বিভিন্ন ভর্তাঃ নানান পদের ভর্তা পান্তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
  • ডালের বড়া ভাজাঃ ঐতিহ্যবাহী সঙ্গী হিসেবে এটিও বেশ জনপ্রিয়।
  • লেবুর রসঃ হজমশক্তি বাড়াতে আর স্বাদ যোগ করতে লেবুর রসের জুড়ি নেই।
  • সরিষার তেল ও লবণঃ পান্তার মূল স্বাদ আনতে এই দুটোর ব্যবহার আবশ্যক।

পান্তা ভাত গরম করে খেলে কি হয়

আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, পান্তা ভাতে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়ামের জৈবপ্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেলেও গরম করলে এই সুবিধাগুলো আর পাওয়া যায় না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পান্তার গাঁজনকারী ব্যাকটেরিয়া পেটের স্বাস্থ্য ও হজমে সহায়ক। তাপ প্রয়োগে এই উপকারী অণুজীব ধ্বংস হয়ে পান্তার মূল স্বাস্থ্য উপকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। পান্তা ভাত গরম করলে যা ঘটে সেটি নিচে উল্লেখ করা হলোঃ 

  • পান্তা ভাতে থাকা উপকারী প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি তাপমাত্রায় মারা যায়।
  • ১১০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে গরম করলে গাঁজনের সুফল নষ্ট হয়ে যায়।
  • পান্তার শরীর ঠান্ডা রাখার প্রাকৃতিক ক্ষমতা কমে যায়।
  • গাঁজনের মাধ্যমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত খনিজ উপাদান যেমন আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়ামের জৈবপ্রাপ্যতা কমে যায়।

পান্তা ভাত খাওয়া কি হারাম

আপনারা অনেকেই হয়তো ভাবছেন, আমাদের প্রিয় পান্তা ভাত ইসলামী দৃষ্টিতে খাওয়া জায়েজ কিনা। এই বিষয়ে ইসলামী ফিকহের নীতিমালা বেশ স্পষ্ট। কোনো খাবার হারাম হওয়ার মূল কারণ হলো তা নেশা সৃষ্টি করে বা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

পান্তা ভাত তৈরির সময় গাঁজনের ফলে অল্প পরিমাণে অ্যালকোহল তৈরি হতে পারে, যা সাধারণত ১% এর নিচে থাকে। ইসলামী স্কলারদের মতে, এই পরিমাণ অ্যালকোহল নেশা তৈরি করে না, তাই তা হালাল। আমাদের দেশের প্রখ্যাত আলেম শায়েখ আহমাদুল্লাহসহ অনেকেই পান্তার এই প্রাকৃতিক গাঁজন প্রক্রিয়াকে বৈধ বলেছেন।

তবে তিনি পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক আচরণ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। ভারতের আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দেখায়, ১২ ঘণ্টার গাঁজনে পান্তায় আয়রন ও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বাড়লেও অ্যালকোহলের মাত্রা নিরাপদই থাকে।

ফিকহের বিখ্যাত গ্রন্থ "ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়িমাহ"-তেও বলা হয়েছে, অ্যালকোহলযুক্ত খাবার যদি নেশা না করে, তবে তা গ্রহণ করা যায়। তবে, ২৪ ঘণ্টার বেশি গাঁজন এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ তখন অ্যালকোহলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।

ব্যক্তিগত মতামতঃ সকালে পান্তা ভাতের উপকারিতা

সকালে পান্তা ভাতের উপকারিতা নিয়ে যখন আমি মন খুলে বলতে চাই, তখন প্রথমেই মনে হয়, এ তো শুধু খাবার নয়, এ আমাদের প্রাণ জুড়ানো এক সংস্কৃতি। আপনারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, সামান্য ভাত যখন সারারাত ধরে পান্তায় রূপান্তরিত হয়, তখন তার মধ্যে কী অসাধারণ পরিবর্তন ঘটে? আমার কাছে এটা সত্যিই বিস্ময়কর লাগে। যেমন ধরুন, পান্তা ভাতে আয়রনের পরিমাণ সাধারণ ভাতের চেয়ে প্রায় ২১ গুণ বেড়ে যায়, আর ক্যালসিয়ামও বাড়ে অনেকখানি।

এই পুষ্টি উপাদানগুলো আমাদের দিন শুরু করার জন্য কতটা দরকারি, তা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন। এটি খেলে যেমন শরীরে তাৎক্ষণিক শক্তি আসে, তেমনি এর প্রোবায়োটিক গুণ হজমশক্তিকেও চাঙ্গা রাখে। আর গরমের দিনে এর ঠান্ডা আমেজ তো শরীর ও মন দুটোই জুড়িয়ে দেয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এমন একটি প্রাকৃতিক ও উপকারী খাবার আমাদের সকলেরই সকালের পাতে একটু জায়গা করে নেওয়া উচিত।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সব বাজ ব্লগিং ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url